পদ চেয়ে আছি...
- হাসান আমান
- ০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:২৯
বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা শতভাগ আওয়ামী মন্ত্রিসভা। ৪৬ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সবাই আওয়ামী লীগের। সেখানে ১৪ দলের কেউ জায়গা পাননি। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের ঐক্যমতের সরকারে দুইজন পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন জাতীয় পার্টি (জেপির) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং প্রাণী, মৎস ও পশু সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি’র) আ স ম আব্দুর রব।
২০০৯ সালের দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারেও এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে তার ভাই জি এম কাদের বেসরকারি বিমান ও পরিবহণ ও পরে বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া শরিক দল সাম্যবাদী দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়াও টেকনোক্রেট কোটায় শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর গঠিত মন্ত্রিসভায় শরিকদলের বেশ কয়েকজন নেতা সুযোগ পেয়েছিলেন।
সেই সরকারে এরশাদের জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পানি সম্পদ মন্ত্রী পরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী হয়েছিলেন, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী পরে সমাজকল্যান মন্ত্রী এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের হাসানুল হক ইনু তথ্যমন্ত্রীর ও জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রথমে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী পরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া জাতীয় পার্টির আরো দুইজন নেতা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তারা হলেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী।
কিন্তু ২০১৯ সালের নতুন মন্ত্রিসভায় শরিকদলের কোন নেতাই সুযোগ পাননি। তবে তারা মন্ত্রী হওয়ার আশাও একেবারে ছেড়ে দেননি।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, যিনি পুর্ববর্তী সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন, তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এই মন্ত্রিত্বের বিষয়ে তাদের সাথে আগে আলোচনা করা হয় নি। যেটা তিনি অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন ‘এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ কোন সন্দেহ নেই। তবে এখানে যে অসুবিধাটা হলো সেটা হল এটা পুরোপুরি ভাবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে ১৪ দলের অন্য যেসব নেতা রয়েছেন তাদের সাথে আলাপ আলোচনা হয় নি। যেটা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার। আগামী দুই একদিনের মধ্যে এই সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা আমরা পাবো।’
সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার মন্ত্রীত্বের শেষ কার্যদিবসে শরিকদের মন্ত্রীত্ব না দেয়ার বিষয়ে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন বলে জানান।
যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার বলেছেন, কাউকে মন্ত্রী করার শর্তে ১৪ দল গঠন করা হয়নি। মন্ত্রী হলে জোটে আছি, না হলে নাই, বিষয়টি এমন নয়। তাছাড়া পাঁচ বছর অনেক বড় সময়। এর ভেতরে অনেক রদবদল হতে পারে। তখন জোট থেকে বা দলের ভেতর থেকে অনেকেরই ডাক পড়তে পারে।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে নতুন মন্ত্রিসভায় শরিকদের মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
দলের জ্যেষ্ঠ ও প্রভাবশালী নেতাদের মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়া প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, নতুন মন্ত্রিসভায় নবীন-প্রবীণ সবাই আছেন। তবে সিনিয়র মন্ত্রীদের বাদ দেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জানেন। আমি বলব তাদের বাদ দেয়া হয়েছে, এটি বলা ঠিক হবে না। তাদের দায়িত্ব পরিবর্তন হয়েছে। তারা পার্টিতে মনোনিবেশ করবেন। দল যাতে সরকারে হারিয়ে না যায়, সিনিয়র ও পোড়খাওয়া নেতারা সে দায়িত্ব পালন করবেন।
এবারে এই ছোট ছোট নাম ও প্যাড সর্স্বস্ব ছোট দলগুলো থেকে কেউ মন্ত্রী হন নি। এখন পর্যন্ত ঘোষিত মন্ত্রীদের নামের মধ্যে শরিকদের কারো নাম না থাকার ফলে জোটের মধ্যে কি কোন অস্বস্তির সষ্টি হবে?
বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ বড়ুয়া বলছিলেন ‘আমাদের ১৪-দলীয় জোটের মধ্যে এই নিয়ে কোন রকমের সংশয়, দ্বিধা বা কোন রকম সমস্যার সৃষ্টি হবে না। আমরা পলিটিক্যালি দেখছি, সেখানে ১৪ দল খুব সুসংহত। কাজেই এখানে মন্ত্রিত্বের বিষয়টি গৌণ।’
শরিক দলের কিছু নেতা মনে করছেন, মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার রয়েছে। সেখানে নতুনদের সুযোগ দেয়া এবং নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।
তবে মন্ত্রিসভায় নাম লেখানোর এখনো সময় আছে বলে মনে করছেন কয়েকজন নেতা।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া আছে তবে, সবার উপরে তারা রাজনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
এদিকে মহাজোটের আরেক শরিক দল, জাতীয় পার্টি এবার ২২টি আসন পেয়েছে।
জাতীয় পার্টি ঘোষণা করেছে, তারা সংসদে বিরোধী দল হিসেবেই থাকবে এবং কোন মন্ত্রিত্ব তারা চাচ্ছে না। তবে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদটি চাইতে পারেন এবং বিরোধী দলের নেতাকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়ার দাবি করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এর আগে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল হলেও তাদের চারজন সংসদ সদস্য সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
মহাজোটের অন্য শরীক দলগুলোর মধ্যে এবারের নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির তিনজন, জাসদের দুইজন, বিকল্প ধারা থেকে দুইজন, তরিকত ফেডারেশন ও জেপি-র একজন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ্ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সাবেক তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তবে রাতে শপথ অনুষ্ঠান শেষেই তিনি সুস্থ হয়ে নিজ বাসায় ফিরে যান।
এর আগে গত বছর কুষ্টিয়ায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় এক জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ইনু বলেছিলেন, তারা সংখ্যায় বিপুল না হলেও তাদের ছাড়া ‘হাজার বছরেও’ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
‘আপনারা ৮০ পয়সা থাকতে পারেন। আপনি এক টাকার মালিক না। যতক্ষণ এক টাকা হবেন না ততক্ষণ ক্ষমতা পাবেন না। আপনি ৮০ পয়সা আর এরশাদ, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন আর ইনু মিললে তবেই এক টাকা হবে। আমরা যদি না থাকি তাহলে ৮০ পয়সা নিয়ে আপনারা (আ. লীগ) রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবেন।’
তার সেই বক্তব্যকে ভালভাবে নেয়নি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াও দেখান সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
তবে হাসানুল হক ইনু জনসভায় দেয়া তার সেই বক্তব্যের ব্যাখা দিয়েছেন। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, শেখ হাসিনা শরিক দলগুলোর অতীত ইতিহাস জেনে-শুনে, বুঝে-শুনে ঐক্য গড়ে তুলেছেন মন্তব্য করে জাসদ সভাপতি বলেন, “শেখ হাসিনা ৯৯ পয়সা অথবা ৮০ পয়সার মালিক হয়েও ২০ পয়সা অথবা এক পয়সার মালিক সমতুল্য শরিকদের উনি কদর করেছেন, দাম দিয়েছেন এবং ঐক্যে শামিল করেছেন। মহাজোট গঠন করে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
‘কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শেখ হাসিনার এই দরদৃষ্টি ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের পরেও কতিপয় নেতানেত্রী তারা ঐক্যকে খাটো করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে থাকেন। ঐক্যের শরিকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন এবং তাদের প্রতি তির্যক মন্তব্য করেন। আমি মনে করি এটা ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জঙ্গিবাদবিরোধী সংগ্রামকে দুর্বল করে।’
তবে হাসানুল হক ইনু বা রাশেদ খান মেননরা এমনকি সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াও মন্ত্রীত্বের আশা একেবারে ছেড়ে দেননি।
এর আগের মন্ত্রিসভায়ও (২০০৯ সালের) শুরুর দিকে ইনু বা মেননদেরকে জায়গা দেয়া হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রয়াত সুরঞ্জিত বাবুকেও নেয়া হয়নি। ওবায়দুল কাদেরও সেসময় মন্ত্রিসভার সদস্য হননি। কিন্তু ক্রমাগত তারা সরকারের ভুল বা অন্যায় কর্মকান্ডের সমালোচনা করে আসছিলেন। সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিতেন। এতে সরকার প্রায়শই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তেন। সরকারের সমালোচনা করায় তাদের ভাগ্য খুলে যায়। সুপ্রসন্ন হয় তাদের পড়ন্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।
হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ওবায়দুল কাদের ও প্রয়াত সুরঞ্জিত গুপ্তকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দেন। এরপর তারাও সরকারের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। যদিও সুরঞ্জিত বাবু রেলের ‘কালে বিড়ালের’ খপ্পরে পড়ে মন্ত্রিসভা থেকে পরবর্তীতে ছিটকে পড়েন।
ইনু-মেননরা যে একেবারেই মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েছেন বা তাদেরকে ছুড়ে ফেলা দেয়া হয়েছে ব্যাপারটা হয়তো সেরকম নয়। মন্ত্রিসভায় হয়তো আবারো তাদের দেখা যেতে পারে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন ও মর্জির উপর।
(লেখকের নিজস্ব অভিমত, এজন্য নয়া দিগন্ত কোনভাবেই দায়ী নন)